Saturday, 19 March 2011

লিবিয়ায় বিমান হামলা


                                      লিবিয়ায় বিমান হামলা



 
 
 
           লিবিয়ায় বিমান হামলা শুরু হয়েছে। গতকাল শনিবার রাতে ফ্রান্সের অন্তত ২০টি যুদ্ধবিমান লিবিয়ার আকাশসীমায় প্রবেশ করে। এসব বিমান থেকে গুলি করে লিবিয়ার সামরিক বাহিনীর চারটি ট্যাংক ও বেশ কয়েকটি সাঁজোয়া গাড়ি ধ্বংস করা হয়। বিমানগুলো সেখানে কয়েক ঘণ্টা অবস্থান নিয়ে বিদ্রোহীদের ওপর লিবিয়ার নেতা মুয়াম্মার গাদ্দাফির অনুগত সেনাদের হামলাও প্রতিহত করে। যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধজাহাজ থেকেও লিবিয়ায় ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপের খবর পাওয়া গেছে।
ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে গতকাল সন্ধ্যায় বিশ্বনেতাদের বৈঠকে লিবিয়ায় সরাসরি সামরিক হামলা চালানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এর আগে গত বৃহস্পতিবার জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে লিবিয়ার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে নো ফ্লাই জোন প্রতিষ্ঠাসহ ‘প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ’ নেওয়ার প্রস্তাব পাস হয়।
এদিকে যুদ্ধবিরতির ঘোষণা সত্ত্বেও বেনগাজির নিয়ন্ত্রণ নিতে গাদ্দাফি বাহিনী গতকাল ট্যাংক নিয়ে অভিযান চালায়। তবে যুদ্ধবিরতি ভাঙার জন্য গাদ্দাফি বাহিনী ও বিদ্রোহীরা পরস্পরকে দায়ী করে।
হামলা শুরু: ফ্রান্সের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র লরেন্ট টিসেইরে জানান, ফ্রান্সের বিমান থেকে গুলি করে লিবিয়ার সামরিক বাহিনীর চারটি ট্যাংক ধ্বংস করা হয়েছে। অপর একজন মুখপাত্র জানান, লিবিয়ায় অভিযানে ফ্রান্সের অন্তত ২০টি যুদ্ধবিমান অংশ নেয়। এসব বিমান বিদ্রোহীদের ওপর গাদ্দাফির সেনাদের হামলা প্রতিহত করে।
এর আগে ফ্রান্সের সামরিক সূত্রে জানা যায়, লিবিয়ার নেতা গাদ্দাফির শক্ত ঘাঁটি এবং গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন স্থাপনা চিহ্নিত করতে লিবিয়ার আকাশে ফরাসি বিমান পাঠানো হয়। সেখানে এসব বিমান কোনো ধরনের বাধার মুখে পড়েনি।
প্যারিসে বৈঠকের পর ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট নিকোলা সারকোজি গতকাল রাতে বলেন, ‘বন্ধু রাষ্ট্রগুলোর মতো আমরাও বেনগাজির জনগণের ওপর যেকোনো ধরনের হামলার বিরুদ্ধে। গাদ্দাফির সেনারা বেনগাজিতে বিমান হামলার চেষ্টা করলে আমাদের যুদ্ধবিমান সেই পরিকল্পনা নস্যাৎ করে দেয়।’ সারকোজি বলেন, নিরস্ত্র বেসামরিক জনগণের ওপর হামলা চালাতে গাদ্দাফির সেনারা ট্যাংক ব্যবহার করতে পারে। তা ঠেকাতেও আমাদের বিমান প্রস্তুত রয়েছে।’
প্রেসিডেন্ট সারকোজি অভিযোগ করেন, গাদ্দাফি জাতিসংঘের প্রস্তাব এবং যুদ্ধবিরতির ব্যাপারে তাঁর নিজের অঙ্গীকার ‘সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা’ করেছেন। তবে তিনি বলেন, ‘জাতিসংঘের প্রস্তাব মেনে নিয়ে ভয়ংকর পরিস্থিতি এড়ানোর মতো সময় এখনো গাদ্দাফির হাতে রয়েছে। বেসামরিক জনগণের ওপর হামলা বন্ধ করলে এ ব্যাপারে কূটনৈতিক সমাধানের দরজা এখনো খোলা রয়েছে।’ প্রেসিডেন্ট সারকোজি বলেন, ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা ও আরব বিশ্বের বন্ধু রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে নিয়ে ফ্রান্স লিবিয়ার জনগণকে রক্ষায় দায়িত্ব পালন করবে।
প্যারিসের বৈঠকে জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন, মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন, জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মেরকেল এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ও আরব লিগের নেতারা অংশ নেন।
বড় অভিযানের প্রস্তুতি: হামলা শুরু হলেও লিবিয়ায় বড় ধরনের সামরিক অভিযানের প্রস্তুতি এগিয়ে চলছে। সম্ভাব্য অভিযানে অংশ নিতে যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনী ভূমধ্যসাগরে আরও যুদ্ধজাহাজ পাঠাচ্ছে। লিবিয়ায় নো ফ্লাই জোন প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনায় কমান্ডার-ইন-চার্জের দায়িত্ব মার্কিন অ্যাডমিরাল স্যামুয়েল লকলেয়ারকে দেওয়া হতে পারে। মার্কিন কর্মকর্তারা জানান, গতকাল মধ্যরাতে ভূমধ্যসাগরে অবস্থানরত মার্কিন নৌবাহিনীর তিনটি ডুবোজাহাজ লিবিয়া অভিযানে অংশ নেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
ফ্রান্সের সামরিক বাহিনীর একজন মুখপাত্র জানান, আজ রোববার ফ্রান্সের বিমানবাহী রণতরী শার্ল দ্য গল লিবিয়ার উদ্দেশে ফ্রান্স ছেড়ে যাবে।
লিবিয়া অভিযানে ডেনমার্ক ও কানাডা যুদ্ধবিমান পাঠানোর ঘোষণা দিয়েছে। ইতালি, স্পেন ও ফ্রান্স তাদের বিমানঘাঁটি ব্যবহার করতে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। আরব দেশগুলোর মধ্যে সৌদি আরব, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও জর্ডান লিবিয়া অভিযানে ভূমিকা রাখবে বলে জানিয়ে দিয়েছে। আরব বিশ্বের আরও কয়েকটি দেশ এই অভিযানে অংশ নেওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছে।
ন্যাটো আপাতত বিমান থেকে লিবিয়ার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অ্যাওয়াকাস বিমান ইতিমধ্যে সেই পর্যবেক্ষণ শুরু করে দিয়েছে।
ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন বলেন, ‘ব্রিটিশ যুদ্ধবিমান লিবিয়ার আশপাশের ঘাঁটিগুলোতে জড়ো হচ্ছে। সময় পেরিয়ে যাচ্ছে, লিবিয়ার বিরুদ্ধে কঠোর ও কার্যকর ব্যবস্থা নিতে আমাদের সর্বাত্মক প্রস্তুতি থাকতে হবে।’
বেনগাজিতে গাদ্দাফি বাহিনীর অভিযান: যুদ্ধবিরতির ঘোষণা সত্ত্বেও বিদ্রোহীদের দখলে থাকা লিবিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম শহরে হামলা চালিয়েছে গাদ্দাফির অনুগত সেনারা। বেনগাজির নিয়ন্ত্রণ নিতে মরিয়া গাদ্দাফি বাহিনী বিদ্রোহীদের দমনে ট্যাংক নিয়ে অভিযান চালায় বলে জানা গেছে। জীবন বাঁচাতে বেনগাজির হাজার হাজার মানুষ শহর ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, গতকাল বেনগাজির আকাশে একটি জঙ্গি বিমান গুলি করে ভূপাতিত করা হয়। এর আগে ওই বিমান থেকে বোমাবর্ষণ করা হয়। বিমানটি ভূপাতিত হলে বিদ্রোহী সেনারা উল্লাস করে। বেনগাজির বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক গোলাগুলির শব্দ পাওয়া যায়।
বেনগাজির একজন নারী কাঁদতে কাঁদতে চিৎকার করে বলেন, ‘কোথায় ফ্রান্স? কোথায় ন্যাটো? আমাদের বাঁচাতে তারা অনেক দেরি করে ফেলছে।’ বেনগাজির বাসিন্দা আবদেল হাফেজ জানান, বেনগাজির দক্ষিণাঞ্চলের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদ্রোহী ও সরকারি সেনাদের মধ্যে তুমুল সংঘর্ষ চলছে।
বেনগাজির একটি হাসপাতালের একজন চিকিৎসকের বরাত দিয়ে বার্তা সংস্থা এপি জানায়, গোলাবর্ষণ অব্যাহত রয়েছে। শুক্রবার সকাল থেকে এখন (শনিবার দুপুর) পর্যন্ত তাঁরা ২৫টি মরদেহ পেয়েছেন।
বিদ্রোহী নেতারা গাদ্দাফি বাহিনীর বর্বরোচিত এ হামলা বন্ধ করার ব্যবস্থা নিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানায়। বিদ্রোহী নেতা মুস্তাফা আবদুল জলিল আল-জাজিরা টেলিভিশনে বলেন, গাদ্দাফি বাহিনী বেনগাজির সব এলাকায় বোমা ও রকেট হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাব বাস্তবায়নে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এগিয়ে না এলে লিবিয়ার জনগণের জীবনে ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে আসবে। তিনি বলেন, ‘সাধারণ জনগণের ওপর এ হামলা বন্ধের ব্যবস্থা নিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আমরা আহ্বান জানাচ্ছি।’
বিদ্রোহী অধিকৃত মিসরাতা শহরেও গাদ্দাফির অনুগত বাহিনী বোমা হামলা ও গুলি চালিয়ে নয়জন বেসামরিক লোককে হত্যা করেছে।
তবে হামলার অভিযোগ অস্বীকার করে লিবিয়ার সরকারের মুখপাত্র মুসা ইব্রাহিম বলেন, ‘বেনগাজিতে সব ধরনের অভিযান বন্ধ রয়েছে। আমরা যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করে তা পর্যবেক্ষণ করছি।’ যুদ্ধবিরতি পর্যবেক্ষণে আন্তর্জাতিক মহলকে লিবিয়ায় আসার আহ্বান জানান তিনি। মুসা ইব্রাহিম পাল্টা অভিযোগে বলেন, সরকারি সেনারা যুদ্ধবিরতি মানলেও বিদ্রোহীরা তা মানছে না। তারা সরকারি সেনাদের ওপর হামলা চালিয়ে যাচ্ছে।
লিবিয়ায় যুদ্ধবিরতি পর্যবেক্ষণ করতে পর্যবেক্ষক পাঠাতে জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুনের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী মুসা কুসা। গতকাল রাজধানী ত্রিপোলিতে সংবাদ সম্মেলনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী মুসা বলেন, ‘আমরা যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করেছি। এতে প্রমাণিত হয়, আমরা জাতিসংঘের সিদ্ধান্ত ইতিবাচকভাবে নিয়েছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের ঘোষণা পর্যবেক্ষণ করতে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক দল পাঠাতে জাতিসংঘের মহাসচিবের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।’
এদিকে ত্রিপোলিতে সংবাদ সম্মেলনে সরকারের একজন মুখপাত্র মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার ও আন্তর্জাতিক নেতাদের প্রতি লেখা গাদ্দাফির চিঠি পড়ে শোনান। এতে বলা হয়, ‘লিবিয়া আপনাদের নয়। লিবিয়া এ দেশের জনগণের। লিবিয়ার প্রতি ব্যবস্থা নিতে নিরাপত্তা পরিষদের যে প্রস্তাব পাস করা হয়েছে, তা অবৈধ। এটি স্বাধীন একটি দেশের ওপর আগ্রাসনের শামিল।’ গাদ্দাফি আরও বলেন, লিবিয়ার জনগণ দেশের জন্য জীবন দিতে প্রস্তুত রয়েছে।
ত্রিপোলিতে গাদ্দাফির বাব আল-আজিজিয়া প্যালেসের চারপাশে অবস্থান নিয়েছে তাঁর সমর্থকেরা। তারা যেকোনো ধরনের হামলা থেকে গাদ্দাফিকে বাঁচানোর অঙ্গীকার করে।
আন্তর্জাতিক রেডক্রস কমিটি এক বিবৃতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছে, বর্তমান পরিস্থিতিতে লাখো বেসামরিক জনগণের জীবন হুমকির মুখে পড়েছে। বিবৃতিতে উভয় পক্ষকে আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের আহ্বান জানানো হয়।
প্রসঙ্গত, ১৯৬৯ সালে রক্তপাতহীন এক অভ্যুত্থানে ক্ষমতায় আসেন সেনা কর্মকর্তা গাদ্দাফি। তাঁর প্রায় ৪২ বছরের শাসনের অবসানের দাবিতে গত ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে দেশটিতে সরকারবিরোধী বিক্ষোভ শুরু হয়। বিদ্রোহীরা বেনগাজি ও ত্রিপোলির পশ্চিমের শহর জাবিয়াহসহ বেশ কিছু এলাকা দখল করে নেয়। গাদ্দাফির অনুগত সেনাদের সঙ্গে বিরোধীদের সংঘর্ষে এ পর্যন্ত কয়েক হাজার মানুষ নিহত হয়েছে। সূত্র: এএফপি, বিবিসি, আল-জাজিরা, রয়টার্স।

No comments:

Post a Comment