Tuesday, 8 March 2011

এক বেলা শিক্ষকতা অন্য বেলা দিনমজুরি

এক বেলা শিক্ষকতা অন্য বেলা দিনমজুরি


রঞ্জিত কুমার রায় দিনের এক বেলা দিনমজুরি, আরেক বেলায় শিক্ষকতা করেন 
            
 
 
             রোদটা বড্ড তেতে উঠেছে। দরদর করে ঘামছেন রঞ্জিত। ইটের ভারী বোঝায় টন টন করছে কাঁধটা। মাথা তুলে একবার ওপরের দিকে তাকালেন। সূর্য তখন মধ্য আকাশে। ফেরার সময় হয়ে এসেছে তাঁর। শেষ বোঝাটা নামিয়ে ভাটা-ব্যবস্থাপকের কাছে গেলেন। আধাবেলার মজুরি বুঝে নিয়ে ইটভাটার এক কোণে রাখা সাইকেলটার দিকে এগোলেন। ধুলোয় ভরা পরনের ছেঁড়া গেঞ্জিটা খুলে ব্যাগ থেকে ধোয়া জামাটা বের করে গায়ে চড়ালেন। দ্রুত প্যাডেল মেরে পথ চলতে শুরু করলেন। তাঁকে যেতে হবে ১৫ কিলোমিটার দূরে।
একসময় একটি মাদ্রাসার আঙিনায় এসে থামলেন রঞ্জিত। ঢুকলেন শ্রেণীকক্ষে। ছেলেমেয়েরা উঠে দাঁড়িয়ে তাঁকে সম্মান জানাল।
একটু আগে যিনি ছিলেন ইটভাটার মজুর, তিনি এই মাদ্রাসার শিক্ষক।
মানুষটার পুরো নাম রঞ্জিত কুমার রায়। বয়স ৩৬। নীলফামারী সদর উপজেলার বেরাকুটি বরুয়া দাখিল মাদ্রাসায় বাংলা আর ইংরেজি পড়ান। কোনো মাইনে পান না। সংসার চালাতে তাঁকে দিনমজুরি খাটতে হয়। ঘামে ভেজা সেই টাকায় চলে সংসার।
রঞ্জিতের বাড়ি মাদ্রাসা থেকে এক কিলোমিটার দূরে দিনাজপুরের খানসামা উপজেলার ডুবুলিয়া গ্রামে। ঘরে তাঁর স্ত্রী ও দুটি ছেলেমেয়ে।
প্রায় এক বছর রঞ্জিত কাজ করছেন সৈয়দপুরের এবিএল (২) ইটভাটায়। ইটভাটায় গিয়ে সম্প্রতি কথা হয় তাঁর সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘কোনো দিন সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত ইটভাটায় কাজ করি। বিকেলে মাদ্রাসায় পড়াই। কোনো দিন বিকেলে কাজ করি, সকালে পড়াই। আধাবেলার মজুরি ১০০ টাকা পাই। ছুটির দিনে পুরো বেলা কাজ করি।’
রঞ্জিত রায় ১৯৯৫ সালে দিনাজপুর কেবিএম কলেজ থেকে স্নাতক পাস করেন। ২০০০ সালে এ মাদ্রাসায় যোগ দেন। পৈতৃক সূত্রে পাওয়া ১৫ শতাংশ আবাদি জমি বিক্রি করে সেই টাকা দেন মাদ্রাসার উন্নয়ন খাতে। কিন্তু যোগদানের ১১ বছরেও সেখান থেকে কোনো পারিশ্রমিক পাননি। কারণ মাদ্রাসাটি এমপিওভুক্ত হয়নি। এত দিন বহু কষ্টে সংসার চালিয়েছেন। এখন যেন আর চলে না।
গৃহশিক্ষকের কাজ করলে তো পারেন—এমন প্রশ্নের জবাবে রঞ্জিত বলেন, ‘এটি দরিদ্র এলাকা। যাঁরা একটু সচ্ছল, তাঁদের ছেলেমেয়েরা পড়ে শহরের স্কুল-কলেজে। তা ছাড়া মাদ্রাসার শিক্ষক হওয়ায় আমার কাছে কেউ পড়তে আসে না।’ ‘রঞ্জিত কখনো ক্লাস ফাঁকি দেন না।’ জানালেন মাদ্রাসার সুপার মো. মোস্তফা কামাল।
১৯৯৯ সালে ৮১ শতাংশ জমির ওপর মাদ্রাসাটি প্রতিষ্ঠিত হয়। ১০ কিলোমিটারের মধ্যে আর মাদ্রাসা নেই। সাড়ে ৩০০ ছেলেমেয়ে পড়ে এখানে। এবতেদায়ী শাখায় চারজন ও দাখিল শাখায় নয়জন শিক্ষক এবং তিনজন কর্মচারী আছেন। দাখিল ও প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায়ও (জেএসসি) ভালো ফল করেছে মাদ্রাসাটি।
ডুবুলিয়া গ্রামে গিয়ে রঞ্জিতের খোঁজ করলে একজন বাড়িটি দেখিয়ে দেন। বাঁশের বেড়ার ওপর খড়ের ছাউনি দেওয়া ছোট্ট একটা কুঁড়েঘর। সামনে গিয়ে ডাক দিতেই বেরিয়ে আসেন তিনি।
স্ত্রী শৈব্যা রায় বলেন, ‘আমার স্বামী আমাদের জন্য যে কষ্ট করছেন, তা বলে বোঝানো যাবে না। আমাদের কষ্ট যেন শেষই হয় না। ছেলেটা বাবার কষ্ট বোঝে। তাই কখনো আবদার করে না।’
মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ও রঞ্জিতের প্রতিবেশী মো. জালাল উদ্দিন জানান, রঞ্জিত ছেলেটা শান্ত। ওঁরা চার ভাই। বড় ভাই মারা গেছেন। অন্য ভাইয়েরা মোটামুটি সচ্ছল। কিন্তু রঞ্জিতকে খুব কষ্টের মধ্য দিয়ে জীবন কাটাতে হচ্ছে।
এবিএল (২) ইটভাটার ব্যবস্থাপক গৌরাঙ্গ সরকার বলেন, ‘উনি (রঞ্জিত) বেশ সহজসরল। পরে জেনেছি, তিনি শিক্ষকতাও করেন।’
সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) নীলফামারী জেলা কমিটির আহ্বায়ক নরেশ চন্দ্র রায় প্রথম আলোকে বলেন, ‘একজন শিক্ষককে দিনমজুরি করে বাঁচতে হবে, এটা অবিচার এবং অমানবিক।’ জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা রোকসানা বেগম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা মনে করি, মাদ্রাসাটি এমপিওভুক্ত হওয়া দরকার।’
জানতে চাইলে নীলফামারী-২ (সদর) আসনের সাংসদ আসাদুজ্জামান নূর প্রথম আলোকে বলেন, ‘মাদ্রাসাটা আমাদের বিবেচনায় আছে। আগামীতে এমপিওভুক্ত করতে চেষ্টা করব।’

No comments:

Post a Comment